ডঃ মোহাম্মদ ইউনূসের শাসনের ছয় মাস পূর্ণ হওয়ার উপলক্ষে, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্রমবর্ধমান ঘটনাবলী নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে Rights & Risks Analysis Group (RRAG) সংগঠনটি আজ “Bangladesh: The Case for Establishing OHCHR Field Office” শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে । রিপোর্টে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার কর্তৃক মানবাধিকার লঙ্ঘন, বিচার ব্যবস্থার রাজনৈতিক ব্যবহার, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকট এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়নের চিত্রতুলে ধরা হয়েছে। RRAG জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের প্রতি বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস (OHCHR) প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশেষ রেজোলিউশন গ্রহণ করতে আহ্বান জানিয়েছে।আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ এপ্রিল ২০২৫ পর্যন্ত জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ৫৮তম অধিবেশন অনুষ্ঠিতহবে, যা বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জরুরি সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক গত বছরের ৩০অক্টোবর ২০২৪-এ বাংলাদেশ সফর করেছিলেন এবং তিনি আইনি, প্রশাসনিক ও সামাজিক সংস্কার, অন্তর্বর্তীকালীন ন্যায়বিচার, জনগণের পুনর্মিলন ও আরোগ্যের জন্য জাতিসংঘের সক্রিয় ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু ডঃ ইউনূসের সরকার জাতিসংঘের এই আহ্বানকে উপেক্ষা করে OHCHR-এর উপস্থিতি বাড়ানোর অনুমতি দেয়নি।
RRAG-এর প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ডক্টর ইউনূসের সরকারের ছয়মাসের শাসনামলে মানবাধিকার পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিচার ব্যবস্থার অপব্যবহার করা হচ্ছে।ডক্টর ইউনুস সরকার বিচার ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে, যার মাধ্যমে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের দমন করা হচ্ছে।ঢাকার মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, ৩১ জানুয়ারি ২০২৫পর্যন্ত, ১,৫২০টি মামলায় ৫,০৪,২০৮ জন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে আসামি করা হয়েছে। এরমধ্যে, ৭৪,২২৪ জনের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে এবং ৪,২৯,৯৮৪ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।এই বিপুল সংখ্যক মামলার অধিকাংশই বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা, কর্মী, ছাত্র সংগঠন এবং সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়েছে।
দেশটির গণ মাধ্যম ও সাংবাদিকদের দমন করা হচ্ছে, তাদের নিরপেক্ষ রিপোর্ট প্রকাশে বাধা পাচ্ছে।বর্তমান সরকার স্বাধীন সাংবাদিকতা ও গণ মাধ্যমের কণ্ঠরোধ করছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি।এর মধ্যে ৩৪৮ জন সাংবাদিককে টার্গেট করা হয়েছে – ১৪৭ জনের বিরুদ্ধে ২১টি ফৌজদারি মামলা দায়ের করা হয়েছে, ৩৪ জন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের তদন্ত চলছে, ১৬৭ জন সাংবাদিককে সরকারী অনুমোদন (accreditation) দেওয়া হয়নি।এছাড়া, ডেইলিস্টার ও প্রথম আলোর অফিসে আক্রমণ চালানো হয়েছে তথাকথিত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র সমন্বয়ক ইসলামীক ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা।সময় টিভির পাঁচজন সাংবাদিকের উপর বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে ইতিমধ্যে। ২০২৩ সালের কঠোর Cyber Security Act এখনো বহাল রয়েছে এবং এর অধীনে ২০২৪ সালে ৩৪টি মামলায় ২৪জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংকটে ফেলেছে বহুগুণে। বর্তমান সরকার বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য ব্যাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে ডঃ ইউনুস সরকার ও মুখোশধারী তথাকথিত বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ২১ জন বিচারপতিকে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে বাধ্যতামূলকভাবে অপসারণ করা হয়েছে। ১০ই আগস্ট ২০২৪-এ সুপ্রিমকোর্টের ৬ জন বিচারপতি, ১৬ অক্টোবর হাইকোর্টের ১২ জন বিচারক, এবং ১৯ নভেম্বর আরও ৩ জন হাইকোর্ট বিচারপতিকে বাধ্যতামূলক সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের (NHRC) সব সদস্যকে ৭নভেম্বর ২০২৪-এ পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, অথচ নতুন সদস্য নিয়োগ দেয়নি ডঃ ইউনুস সরকার।
“ডঃইউনূসের সরকার একটি অনুগত বিচার ব্যবস্থা তৈরি করেছে যেখানে বিচারকরা ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও নিরাপত্তার হুমকি বিবেচনা না করে রায় দিতে পারেন না।তদুপরি, জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সমস্ত সদস্যকে নতুন সদস্য নিয়োগ না করে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছিল। বাংলাদেশে ন্যায় বিচারের কোনো ব্যবস্থাই নেই”- বলেছেন RRAG-এর পরিচালক মিঃ সুহাস চাকমা।
বাংলাদেশে বিরোধীদলগুলোর শান্তি পূর্ণ সমাবেশের অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে কোন উন্নতি হয়নি। ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে কার্যকর নিষেধাজ্ঞা, 18 সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ি জেলায় ‘March for Identity’, 25 অক্টোবর চট্টগ্রামের লালদিঘী মাঠে, 22 নভেম্বর 2024 রংপুরে এবং 15 জানুয়ারী 2025 তারিখে ঢাকায় NCTB এর সামনে পাঠ্য পুস্তক থেকে “আদিবাসী” (আদিবাসী) শব্দটি মুছে ফেলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সময় আদিবাসী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা গুরুতর এবং পরিকল্পিত আক্রমণ করে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার শেষ করে দিয়েছে । অন্যদিকে হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী 25 নভেম্বর 2024 থেকে মিথ্যা রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে বন্দী রেখে আদিবাসী এবং সংখ্যালঘুদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ না করার জন্য ডঃইউনূসের সরকার একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে । তাছাড়া, 18-19 তারিখে খাগড়াছড়ি জেলায় আদিবাসীদের উপর হামলার তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট এখনো প্রকাশ করা হয়নি ।
“বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নিপীড়ন ও সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো গভীরভাবে। 4 থেকে 20 আগস্ট 2024-এর মধ্যে 2,000-এরও বেশি হিন্দুদের উপর হামলার ঘটনা ডঃ ইউনুস রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন।এরপরে, বাংলাদেশ পুলিশ 10 জানুয়ারী 2025-এ ডঃ ইউনূস সত্য প্রমাণ করার জন্য বলেছে যে হিন্দুদের উপর হামলার 1,254টি প্রমাণিত অভিযোগ মধ্যে 1,234টি ঘটনা (98.4%) রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত।মানে হিন্দুদের উপর আক্রমণের তদন্ত বিচার দেয়ার জন্য নয়, ডঃ ইউনুসকে সত্য প্রমান করার জন্য।” সুহাস চাকমা আরও বলেন।
গত ১৯-২০ই সেপ্টেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার সদরে ও দিঘীনালা উপজেলার সদরে রাতে সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি বর্ষণকরে এতে চার জন আদিবাসী হত্যার স্বীকার হয় এবং ২০০ অধিক দোকান ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় সেটেলার বাঙালি মুসলিমরা সরাসরি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় বা মদদে। আদিবাসীদের উপর এই সংঘটিত হামলার তদন্ত প্রতিবেদন আজও প্রকাশ করেনি ডঃ ইউনুস সরকার।তাছাড়া গত কয়েকযুগ ধরে আদিবাসী অধ্যুষিত জনগোষ্ঠী অঞ্চল পার্বত্য চট্টগ্রামে সামরিক শাসন অব্যাহত রয়েছে ।
“বাংলাদেশের জন্য একক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হুমকি হল ডক্টর ইউনূস কর্তৃক বৈষম্য বিরোধী ছাত্রআন্দোলনকে অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করে mob rule প্রতিষ্টা করা এবং যেসব কাজগুলি অন্তর্বর্তী সরকার আইনতভাবে করতে পারেনা সেসব কাজগুলি ডক্টর ইউনূস বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করে অবৈধভাবে সম্পাদন করছে।বিচারকদের পদত্যাগ চাওয়া হোক বা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ভয় দেখানো হোক, রাজধানী ঢাকায় জাতীয় পার্টির প্রধান কার্যালয় পুড়িয়ে দেওয়া হোক বা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি৩২ নম্বরের বাসভবন ভাঙা হোক, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহর মার্কা রয়েছে । এটা মোটেও আশ্চর্যের কিছু নয় যে বাংলাদেশে ২০২৪ সালে 2023 সালের তুলনায় গণ পিটুনিতে মৃত্যুর হার ১৩১% বৃদ্ধিপেয়েছে, 2023 সালে 51 জনের মৃত্যুর তুলনায় 2024 সালে 128 জনের গণপিটুনিতে মৃত্যু হয়েছে।“ – এছাড়াও বলেন সুহাস চাকমা ।
RRAG বলেছে যে বাংলাদেশ এখন বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য প্রস্তুত এবং জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের 58তম অধিবেশনে যথাযথ সিদ্ধান্ত নিয়ে বাংলাদেশে OHCHR এর Country Office প্রতিষ্ঠিত না হলে, বাংলাদেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেএবং “অন্তবর্তীকালীনবিচার” সংক্রান্ত সমস্যাগুলির সমাধান করতে সক্ষম হবে না। ইউনূসের সরকারের অধীনে সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে এবংবিক্ষোভকারীদের যারা বিদ্রোহের সময় কমপক্ষে 44 পুলিশকে হত্যা করেছিল দায় মুক্তি করার কারণে শেখ হাসিনার শাসনামলে মানবাধিকার লঙ্ঘনগুলি ছায়াচ্ছন্ন হয়ে গেছে।